
বিশেষ প্রতিনিধি: কারাগারে না পাঠিয়ে ফুল,জাতীয় পতাকা, মুক্তিযুদ্ধের বই আর ডায়েরি হাতে দিয়ে বিভিন্ন লঘু অপরাধে অভিযুক্ত ৬৫ শিশুকে সংশোধনের জন্য প্রবেশনে বাবা-মায়ের জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছেন আদালত। এক্ষেত্রে তাদের ৬ টি বিধিনিষেধ মেনে চলার শর্ত দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে আরেকটি পৃথক রায়ে ২৫ দম্পতিকে একসঙ্গে সংসার করার সুযোগ করে দিয়েছেন আদালত।
সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জাকির হোসেন বুধবার (২০ জুলাই) দুপুরে পৃথক দুটি রায় প্রদান করেন। উক্ত ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) হাসান মাহবুব সাদি রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আদালত সূত্রে জানা যায়, মারামারি ও মাদক বহনসহ লঘু অপরাধে সুনামগঞ্জে ৫২টি মামলায় ৬৫ জন শিশুকে মামলায় জড়ানো হয়। ক্ষুদ্র ‘অভিযোগে’ এসব শিশুদের প্রায়ই আদালতে হাজিরা দিতে হয়। সেকারণে শিশুদের ভবিষ্যত অনিশ্চিয়তা এবং তাদের শিক্ষাজীবন ব্যহত হচ্ছিল। সেক্ষেত্রে শিশুদের এসব অসুবিধা থেকে মুক্তি দিতে কারাগারে না পাঠিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে রেখে সংশোধনের জন্য সুযোগ করে দিয়েছেন আদালত। বাবা-মা মায়ের নিকট পাঠাতে যে ৬টি শর্ত দিয়েছেন। আদালতের দেয়া শর্তগুলো হল- প্রবেশনে থাকাকালে বই পড়ে মুুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানা, এসি-টিভি মোবাইল সার্ভিসিংয়ের যেকোনো একটি বিষয়ে কারিগরি বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণ,গবাদি পশু পালন, প্রতিদিন অন্তত দুইটি ভালো কাজ করা ও প্রদত্ত ডায়েরিতে লিখে রাখা, প্রত্যেকে কমপক্ষে ২০টি করে গাছ লাগানো এবং গাছের পরিচর্যা করা, নিয়মিত ধর্মকর্ম করা এবং বাবা-মায়ের আদেশ নির্দেশ মেনে চলা এবং মাদক থেকে দূরে থাকা ও ভবিষ্যতে অপরাধের কাজে নিজেকে না জড়ানো। এসব শর্তে মামলা নিষ্পত্তি করে দেয়া হয়।
রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে-উল্লেখিত শর্তসমূহ পালন করা হচ্ছে কিনা তা আগামী এক বছর একজন প্রবেশন কর্মকর্তা পর্যবেক্ষণ করবেন এবং প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর আদালতকে অবহিত করবেন।
প্রবেশন কর্মকর্তা শফিউর রহমান বলেন, ‘আদালত যে রায় দিয়েছেন তা দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। শিশুদের ভবিষ্যতে বেড়ে উঠতে কাজে দিবে এতে করে শিশুরা অপরাধ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবে। আদালত এসব ৬৫জন শিশুকে ৬টি প্রবেশন শর্তে তাদের আমার তত্ত্বাবধানে পিতামাতার জিম্মায় দিয়েছেন। মুক্তিপ্রাপ্ত শিশুরা এসব প্রবেশন শর্ত পালন করছে কিনা সেগুলোই আমি দেখভাল করবো।’
আদালতের রায়ে বলা হয়, বিভিন্ন সময়ে দায়ের হওয়া ৫২ টি মামলায় ৬৫ জন শিশু আদালতে এসে হাজিরা দিতে হতো। মারামারি, মাদক বহন, ছোটখাটো চুরির অভিযোগ আনা হয়েছিল এদের বিরুদ্ধে। কোমলমতি এসব শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠতে অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়ে। তাদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হবার উপক্রম হয়। আদালত এই শিশুদের কারাগারের পরিবর্তে মা-বাবার জিম্মায় ফেরৎ পাঠিয়ে শিশুদের জীবন সুন্দর ও মানবিক গুণাবলি নিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিল।
আদালতের এমন রায়ে আবেগাপ্লুত হয়েছেন অভিযুক্ত ৬৫ শিশু, তাদের অভিভাবক ও স্বজনেরা। অভিভবকরা জানালেন এমন রায়ে আমরা আদালতের বিজ্ঞ বিচারকের নিকট কৃতজ্ঞ। এ রায়ে দেয়া শর্তের মাধ্যমে আমরা আমাদের সন্তানদের সংশোধনের একটা সুবর্ণ সুযোগ পেলাম।
সুনামগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) অ্যাডভোকেট হাসান মাহবুব সাদী বলেন, ‘এটি একটি দৃষ্টান্তমূলক ব্যতিক্রমী রায়। আদালতের এমন উদ্যোগ পরিবারের সান্নিধ্যে এসব কোমলমতি শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে এবং সুন্দর জীবন গঠনের সুযোগ পাবে।’
সুনামগঞ্জ জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) খায়রুল কবীর রুমেন বলেন, ‘এর আগে উক্ত আদালতের বিচারক এধরনের আরও কয়েকটি দৃষ্টান্তমূলক রায় দিয়েছেন। এধরনের রায়ে আদালতের প্রতি মানুষের আরো বেশি আস্থা ফিরে আসবে। আদালতে বর্তমানে মামলা জট রয়েছে। এ ধরনের রায়ের মাধ্যমে মামলা জটও কমে আসবে।’
অপরদিকে,আদালত পৃথক রায়ে ২৫টি মামলায় ২৫ দম্পতির দুর্বিসহ জীবন-যাপনের অবসান ঘটান। যৌতুকের দাবিসহ নানাবিধ কারণে নির্যাতনের স্বীকার হয়ে সংসার থেকে বিতাড়িত ২৫ নারী স্বামীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে আদালতে মামলা করেছিলেন। বিচারক উভয়ের বক্তব্য শুনে তাদের সন্তানসহ নিজেদের মঙ্গলের জন্য শর্ত সাপেক্ষে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন এটে ২৫ যুগলের পারিবারিক মিলনের ব্যবস্থা করে দেন।
প্রসঙ্গত,একই আদালত ইতিপূর্বে কয়েক দফায় ১৪৫ মামলায় ২০০ শিশুকে মা-বাবার কাছে এবং ২২৫টি মামলা আপোষে নিষ্পত্তি করে দাম্পত্য কলহ মিটিয়েছেন উক্ত আদালত।