বিশেষ প্রতিনিধি: সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নরমাল ডেলিভারি (স্বাভাবিক সন্তান প্রসব) কাজে সহায়তাকারি,প্রসূতি মায়েদের আস্থা ও ভরসার প্রতীক সেবিকা সীমা রানী চন্দ। নরমাল ডেলিভারি করানোর ক্ষেত্রে হাওরাঞ্চলে রেকর্ড গড়েছেন এ স্বাস্থ্যকর্মী। গত ৯ বছরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ও বাড়িতে গিয়ে মোট ১ হাজার ৫৬৩জন স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করিয়েছেন তিনি। প্রসূতি মায়েদের মুখে মুখে এখন সীমা চন্দের নাম। সবাই তার ভূয়সী প্রশংসা করছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে একাধিকবার বিভিন্ন পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
সীমা রানী চন্দের পিতার নাম সুনীল চন্দ, মাতার নাম শেলি রাণী চন্দ। তার পৈত্রিক বাড়ি জেলার তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট গ্রামে। বৈবাহিক সূত্রে বর্তমানে তিনি বর্তমানে জামালগঞ্জ উপজেলার উত্তর কামলাবাজ গ্রামের বাসিন্দা। তার স্বামী জয়দেব চন্দ জামা তৈরির কারিগর। সাংসারিক জীবনে তিনি দুই ছেলে সন্তানের জননী। বড় ছেলে সীমান্ত চন্দ সুনামগঞ্জ সরকারি মহাবিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ে অনার্স কোর্সে ও ছোট ছেলে অর্ণব চন্দ জামালগঞ্জ সরকারি মডেল হাই স্কুলে দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত।
জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের রামপুর ও লম্বাবাঁক কমিউনিটি ক্লিনিকে সিএসবি (দক্ষ প্রসব সহায়তাকারি) হিসেবে কর্মরত আছেন সীমা রানী চন্দ। গত বছর মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ধানুয়াকালী গ্রামের সালমা আক্তার নামের এক প্রসূতি মায়ের স্বাভাবিক ডেলিভারি সম্পন্ন করে ১ হাজার ৪০০টি স্বাভাবিক ডেলিভারির মাইলফলক স্পর্শ করেন। চলতি বছরের ৮ মে উপজেলার লম্বাবাঁক গ্রামের স্মৃতি বেগমের সন্তানকে নরমাল ডেলিভারি করার মধ্য দিয়ে তিনি ১হাজার ৫৬৩ জন শিশুকে স্বাভাবিক ডেলিভরির মাধ্যমে পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছেন। এর মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকে অর্ধ শতাধিক এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে অপর শিশুদের ভুমিষ্ট করান তিনি।
সীমা রানী চন্দ ২০১৪ সালে প্রাইভেট সিএসবি সেবিকা হিসেবে যোগ দেন। ২০১৩ সালে একটি বেসরকারি এনজিও সংস্থার সহযোগিতায় নেত্রকোনা নার্সিং ইন্সটিটিউটে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তারপরের বছর অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি ডেলিভারির কার্যক্রম শুরু করেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে সীমা রানী চন্দ তার কাজের মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সবার কাছে আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেন। সীমা রানী চন্দ প্রথম ডেলিভারির কাজটি করেছিলেন বুকে দূরুদূরু ভয় নিয়ে। এক ঘন্টার চেষ্টায় সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সেদিন স্বাভাবিক বাচ্চা প্রসব করান তিনি।
সীমা রানী চন্দ জানান, চলতি মে মাসের ৮ তারিখ পর্যন্ত ৬টি এবং এপ্রিল মাসে ৮টিসহ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত মোট ৪০টি নরমাল ডেলিভারি করিয়েছেন তিনি। সবগুলোই তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে করেছেন। বিশেষ করে হতদরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ যারা সীজারিয়ান অপারেশন করাতে পারেন না তারা খুব সহজে নরমাল ডেলিভারির আস্থা নিয়ে তার দ্বারস্থ হন। তাদের নরমাল ডেলিভারির জন্য শতভাগ চেষ্টা করেন তিনি। এদের মধ্যে যেসব রোগীর শারীরীক অবস্থা খারাপ থাকে, সেসব জটিল রোগীদের যথাযথ চিকিৎসার জন্য তিনি সুনামগঞ্জ জেলা সদরের মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন। তিনি জানান, জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিতে চাননা। যেসব মায়েদের স্বাভাবিক ডেলিভারিতে প্রতিবন্ধকতা থাকে না, তাদের নিয়ে কাজ করেন তিনি। এখন পর্যন্ত তার হাতে কোন মাতৃ মৃত্যু ঘটেনি। প্রতিটি শিশু ও মা সুস্থ রয়েছেন। গ্রামীন পর্যায়ে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নতির লক্ষ্যে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যতদিন সুস্থ থাকবেন ততদিন এই সেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসবকারি জামালগঞ্জ উপজেলার লম্বাবাঁক গ্রামের ইয়াসমিন আক্তার, উত্তর কামলাবাজ গ্রামের শাহেনা বেগম, একই গ্রামের নাবিল বেগমসহ বেশ কয়েকজন প্রসূতি মা জানান, সীমা রানী চন্দের ব্যবহার ও আচার আচরণে তারা সন্তুষ্ট। তারা বলেন, তাকে যখন ফোন দেওয়া হয় তখনই তাকে পাওয়া যায়। নরমাল ডেলিভারির জন্য সীমা রানী চন্দ এলাকার মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
জামালগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মঈন উদ্দিন আলমগীর বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিক ও বাড়িতে গিয়ে ১৫০০ এর অধিক স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করানোটা অত্যন্ত গৌরবের। হাওরাঞ্চলে এ সেবাটা খুবই প্রয়োজন। এখানকার যে যাতায়াত ব্যবস্থা ইচ্ছে করলেই একজন প্রসূতি মাকে উপজেলা, জেলা সদর কিংবা বিভাগীয় সদরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। সীমা রানী চন্দ হাওরাঞ্চলে অসহায় প্রসূতি মায়েদের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। পাশাপাশি সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে তিনি উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: জুনায়েদ চৌধুরী জীবন