সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের ঐক্যের রাজনীতিতে বিভাজনের সুর বেজে উঠেছে। সদ্য সমাপ্ত সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল হুদা মুকট ও সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিনের মধ্যে এই বিভাজনের সৃষ্টি হয়। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নুরুল হুদা মুকুটের সহোদর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক খায়রুল হুদা চপলের পক্ষে কাজ না করায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় বক্তব্য প্রদান করেন নুরুল হুদা মুকুট। তিনি বিক্ষুব্ধ বক্তব্যে পলিন ও তাঁর পরিবারের প্রতি রাজনৈতিক বিষোদগার করেন।
সম্প্রতি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিনের বিরুদ্ধে দলের সভাপতির বিক্ষুব্ধ বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়। এতে দলের শীর্ষ দুই প্রভাবশালী নেতার বিভাজন প্রকাশ্যে রূপ নেয়। দলে দেখা দেয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। মুকুটের বিক্ষুব্ধ এই বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্য সাধারণ সম্পাদকের পক্ষ থেকে না আসলেও সাধারণ সম্পাদক বলয়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে স্নায়ু উত্তেজনা দেখা দেয়। তাঁরা নোমান বখত পলিনের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আলাদা অবস্থান জানান দিচ্ছেন। তবে দলের প্রভাশালী শীর্ষ এই দুই নেতার দাবি, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগে কোনো বিভাজন সৃষ্টি হবে না।
সুনামগঞ্জের প্রভাবশালী এই দুই পরিবারের নিয়ন্ত্রণে জেলা আওয়ামী লীগ শক্তিশালীভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। দুই বলয়েই রয়েছে বিশাল কর্মী,সমর্থক বাহিনী। তবে মাঝখানে দীর্ঘদিন দলের শীর্ষ পদের বাইরে ছিলো প্রভাবশালী এই দুই পরিবার। দীর্ঘ সময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন সাবেক৷ সংসদ সদস্য মতিউর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমন। ওইসময় দলের শীর্ষ পদের বাইরে থেকেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির মাঠে সরব ছিলেন, নুরুল হুদা মুকট ও বখত পরিবার। বলা চলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দাপুটে নেতা তাঁরা। দীর্ঘদিন পদ-পদবীর বাইরে থেকেও দলের দুঃসময়ে রাজপথে বিরোধী রাজনৈতিক দলের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রাজপথে আন্দোলন, সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো তাঁদের। ১৯৯৭ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিনের অগ্রজ প্রয়াত দুইবারের পৌর মেয়র আইয়ূব বখত জগলুল। ওইসময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, প্রয়াত সংসদ সদস্য আব্দুজ জহুর। আর জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন, দলের বর্তমান সভাপতি নুরুল হুদা মুকুট। পরে ২০০১ সালে আইয়ুব বখত জগলুলকে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলে নুরুল হুদা মুকুটকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালের দিকে প্রয়াত সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের সাথে বখত পরিবারের মতবিরোধ দেখা দিলে নুরুল হুদা মুকুটকে কাছে টেনে নেন আব্দুস সামাদ আজাদ। এক পর্যায়ে প্রয়াত তারকা পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও আব্দুস সামাদ আজাদ নামে সুনামগঞ্জে দুটি বলয় তৈরি হয়। সুরঞ্জিত সেন ভিড়েন বখত পরিবারে। আর সামাদ আজাদ ভিড়েন মুকুট পরিবারে। জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মুকুট ও জগলুল গ্রুপিং রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তখনকার সময় এই গ্রুপিয়ের কারণে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সুনামগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গন। তবে ওই গ্রুপিং রাজনীতি বেশিদিন দীর্ঘায়িত হয়নি। জগলুল রাজনীতির উত্তপ্ত ময়দান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বেশি মনোযোগী হন সুনামগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনের মাঠে। হয়ে ওঠেন দল,মত নির্বিশেষে আপামর জনতার নেতা। টানা দুই মেয়াদে আমৃত্যু সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য ছিলেন জগলুল। এর আগে সুনামগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন তাঁর অগ্রজ প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার বখত নেক।
দীর্ঘ পথপরিক্রমার পর ২০১৬ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সাবেক সংসদ সদস্য মতিউর রহমান সভাপতি ও ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমন সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হলে রাজনীতিতে সৃষ্টি হয় নতুন সমীকরণ। বরফ গলে মুকুট জগলুল সম্পর্কের।২০১৬ সালের জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমন আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনীত প্রার্থী হলে বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী হন নুরুল হুদা মুকুট। ওইসময় সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আইয়ূব বখত জগলুল মুকুটকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে কোমড় বেঁধে নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়েন। বিপুল ভোটের ব্যবধানে ইমনকে পরাজিত করে বিজয়ী হন মুকুট। এই বিজয়ে জগলুলের অবদানকে খাটো করে দেখার অবকাশ ছিলো না। ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মেয়র জগলুল আকস্মিক মৃত্যুবরণ করলে উপনির্বাচনে তাঁর সহোদর নাদের বখতকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। ওই সময় নুরুল হুদা মুকট নাদের বখতের পক্ষে নির্বাচনী মাঠে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। এবং প্রতিটি নিবাচনী সভা৷-সমাবেশে প্রয়াত মেয়র জগলুলের অবদানের কথা স্বীকার করে নাদের বখতের পক্ষে ভোট প্রার্থনা করেন।
২০২১ সালে আমেরিকা থেকে দেশে ফেরেন প্রয়াত মেয়র জগলুলের ছোট ভাই সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিন। ২০২২ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে
পলিনকে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি করা হয়। পরে ২০২৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের সমেলনে সভাপতি পদে নুরুল হুদা মুকুট ও সাধারণ সম্পাদক পদে নোমান বখত পলিন অধিষ্টিত হন।
নতুন কমিটি দায়িত্বভার গ্রহণ করে দলীয় সকল কর্মসূচি একই মঞ্চে একই সঙ্গে পালন করার পাশাপাশি দলকে তৃণমূলে সুসংগঠিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এবং প্রতিটি সভা সমাবেশে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ বলে দাবি করে বক্তৃতা বিবৃতি প্রদান করেন। কার্যত তৃণমূলে চাঙ্গা হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ। নতুন কমিটির বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দলে অনৈক্যের সুর বেজে উঠলো।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিন বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন কোনো দলীয় নির্বাচন ছিলো না। উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত ছিলো। আমি জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ভোটে স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রণের জন্য জনসচেতনামূলক লিফলেট বিতরণ করেছি। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু করিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে নোমান বখত পলিন বলেন, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগে কোনো বিভেদ সৃষ্টি হতে দেবো না। জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে যা যা করার দরকার তাই করবো। এবং দলের ত্যাগী নেতাকর্মী ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রকৃত সৈনিকদের সঙ্গে নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করছি। এজন্য যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমি প্রস্তুত।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকট বলেন, দলে অনৈক্যের কোনো সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ। আওয়ামী লীগ এতো বড় একটি দল নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভেদ থাকবেই। কোনো কথা নিয়ে পরস্পর ভুল বুঝাবুঝি থাকতেই পারে। এগুলো আবার নিজেদের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: জুনায়েদ চৌধুরী জীবন