মোশাহিদ আহমদ, দিরাই: গরু রাখাল ও রেস্তোরাঁ শ্রমিকের কাজ করতেন। সেখান থেকে দাদন ব্যবসা ও জুয়ার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি। শহরের ব্যস্ততম পয়েন্ট ধল রোডে কয়েক কোটি টাকার ভূমিসহ হয়েছেন বিশাল সম্পদের মালিক। সেই জুয়া সম্রাট ও শীর্ষ দাদন ব্যবসায়ী সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান ওরফে হবু (৪৬) এখন গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে হাবিবুর রহমান হবুসহ কয়েকজন দাদন ব্যবসায়ীকে দায়ী করে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সৌম্য চৌধুরী মৃত্যুবরণ করলে তার স্ত্রী ইলা চৌধুরী বাদী হয়ে হবু’সহ ০৫ জনের বিরুদ্ধে দিরাই থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো হবু সহ অভিযুক্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
কে এই হবু
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, হাবিবুর রহমান হবু’র দিনমজুর পিতা আকবুল মিয়ার আদি নিবাস দিরাই পৌর সদরের আয়লাবাজ গ্রামে। ৩০/৩৫ বছর আগে অভাবের তাড়নায় পরিবার নিয়ে উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের শান্তিপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। হবুর ৭/৮ বছর বয়সে পিতা আকবুল মিয়া মারা যান। হবুর মা করিমপুর ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আছাব উদ্দিন সরদারের স্থানীয় টানাখালী বাজারের রাইস মিলে কাজ নেন। ভিটেবাড়ি ছিল না। মিলের পাশে মালিকের করে দেয়া একটি ঝুপড়ি ঘরে বাস ছিল তাদের। সাকিতপুর গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, কিশোর বয়সে সাকিতপুর গ্রামে গরু রাখালের কাজ করতো হবু। সেখান থেকে গ্রামের ইশ^াদ মিয়ার টানাখালী বাজারের খাবার হোটেলে কাজ নেয়। ইশ^াদ মিয়া জানিয়েছেন, তার খাবারের দোকানে কয়েক বছর হবু কাজ করেছে। ২০০০ সালের দিকে হবু পা রাখে দিরাই পৌর শহরে। কলেজ রোডে রিকশার গ্যারেজ দিয়ে শুরু। এরপর জড়িয়ে পড়ে সুদের কারবারে। উপজেলার বেশীরভাগ জুয়াড়িদের সুদে টাকা দিত। এভাবে ধীরে ধীরে উপজেলার জুয়া সিন্ডিকেটের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে আসে হবুর হাতে। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিভিন্ন গ্রামে শীত মৌসুমে মেলা আয়োজন হতো। এসব মেলায় রাতভর চলা জুয়া আসর নিয়ন্ত্রণ করতো সে। একপর্যায়ে প্রশাসনের তৎপরতায় মেলা ঘিরে এসব জুয়ার আসর বন্ধ হয়ে গেলে ভিন্ন পথ অবলম্বন করে হবু। দিরাই পৌর শহরসহ উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে কয়েকটি জুয়ার বোর্ড পরিচালনা শুরু করে। পাতানো জুয়ার মাধ্যমে শত যুবকের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
সুদের টাকা আদায়ে হবু ছিল বেপরোয়া
সৌম্য চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনার মামলার প্রধান আসামী হয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবার পর হাবিবুর রহমান হবু’র সুদের টাকা আদায়ে নির্মমতার কাহিনী এখন মানুষের মুখে মুখে। সুদের টাকা চক্রবৃদ্ধি হারে আদায় করতে হবু ছিল বেপরোয়া। সাদা স্ট্যাম্পে কিংবা চেকে স্বাক্ষর রেখে টাকা দিত সে। হবুর কাছ থেকে সুদের ওপর টাকা নিয়ে নিঃস্ব হয়েছে বহু পরিবার। অভিযোগ আছে, দিরাই সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বেলা রানীর পরিবারে সুদে টাকা দিয়ে পরে তাদের বসতভিটা হুমকি-ধমকি দিয়ে রেজিস্ট্রি করে নেয়। তার রোষানলে পড়ে ওই পরিবারটি দিরাই ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। স্ত্রী-সন্তান সিলেট শহরে বসবাস করায় গার্লস স্কুল সংলগ্ন ওই ফাঁকা বাড়িতে নিয়মিত জুয়ার আসর বসাতো হবু। দিরাই থানা রোডস্থ মর্ডান কম্পিউটারের স্বত্ত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম বলেন, কিছুদিন আগে দোকানের সামনে রাস্তায় পার্কিং করা আমার মোটরসাইকেলটি হবু চুরি করে নিয়ে যায়। জামালগঞ্জ, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে ছোটাছুটি করে পরে জানতে পারি হবু নিয়ে গেছে। পুলিশের মাধ্যমে আমার মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করি। থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়া আছে। পরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হবু জানায়, শফিকুল ইসলামের বড় ভাই তার কাছ থেকে সুদের ওপর টাকা নিয়েছিল। ওই টাকার জন্য সে মোটরসাইকেল নিয়ে গেছে। তবে, শফিকুল ইসলাম বলেন, ৫/৭ বছর আগে আমার ভাই কিছু টাকা নিয়েছিল, যেটা দিরাই পৌরসভার বর্তমান মেয়র বিশ^ দাদাসহ কয়েকজন গন্যমান্য ব্যক্তির মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। গত ২জুন নিজের ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সৌম্য চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর জন্য সুদখোর হাবিবুর (হবু), জসিম উদ্দিনসহ ৫জনের নাম উল্লেখ করে লিখেন, ‘আমার এ পরিণতির জন্য এরা দায়ী। এদের বিচার দাবী করে লিখেন, ‘আমি হয়তো দেখে যেতে পারবো না। সৌম্য চৌধুরীর স্ত্রী ইলা চৌধুরী বলেন, আমার স্বামী আর্থিক সংকটে হবু ও জসিমের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন। পরে আসামীরা একে অপরের সহযোগিতায় ব্যাংকের চেকের খালি পাতায় স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। ধারের টাকাকে সুদে টাকা বলে প্রচার করে। খালি চেকে ইচ্ছেমতো টাকার অংক বসিয়ে আদালতে চেক ডিসঅনারের মামলা দেয়। মামলা চলাকালে তাদের সাড়ে ৪ লাখ টাকার বিপরীতে বাড়ি বিক্রির ৫ লাখ টাকা দিয়ে সাবেক মেয়র মোশাররফ মিয়ার মাধ্যমে নিস্পত্তি হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় আসামীরা আদালত থেকে মামলা প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু হবু ও জসিম প্রতারণা করে। মামলা উঠিয়ে না এনে সুকৌশলে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ায়। রায়ে আমার স্বামীর সাজা হয়। আসামীদের মানসিক নির্যাতন ও হুমকি-ধমকিতে ভীত হয়ে আমার স্বামী আত্মহত্যা করেন।
দিরাই থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাজী মোক্তাদির হোসেন বলেন, সৌম্য চৌধুরীর মুত্যুর ঘটনার মামলার প্রধান আসামী হাবিবুর রহমান ওরফে হবুসহ অন্য আসামীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: জুনায়েদ চৌধুরী জীবন