নোহান আরেফিন নেওয়াজ, শান্তিগঞ্জ: পরাধীন বৃটিশ আমল আর বৈষম্যের পাকিস্তান আমল এবং সর্বশেষ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই তিন আমলের জলজ্যান্ত সাক্ষ্য বহন করছে সুনামগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলাবাজার ডাকবাংলো। শান্তিগঞ্জ উপজেলার ‘রাজনীতির আতুরঘর’ খ্যাত পাগলা বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এর অবস্থান।
ঐতিহাসিক এই ডাকবাংলোতে বসেই আঁকা হয়েছে রাজনীতির উত্তান-পতনের দৃশ্যপট। বাংলোর আঙ্গিনা, বারান্দা, মেঝে আর বিশ্রামাগারে পদচারণা হয়েছিল অসংখ্য গুণীজনের। এছাড়া কখনো নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র, কখনো সরকারী রেশন বিতরণ কেন্দ্র কিংবা কখনো ইউনিয়ন পরিষদের অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল ঐতিহ্যবাহী এই ডাকবাংলো। কালের বিবর্তনে এখন সেসব শুধুই লোকমুখের গল্পের খোড়াক। সঠিক পরিচর্যা ও উন্নয়নের অভাবে জৌলুশ হারিয়ে এখন ময়লার ভাগাড় কিংবা অঘোষিত শৌচাগারে পরিনত হয়েছে কালজয়ী এই স্থাপনাটি।
ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাটি সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথের (সওজ) আওতাধীন হলেও অজানা কারণে এর রক্ষনাবেক্ষণে অনেকটা উদাসীন ক্ষুদ সওজ বিভাগ। তবে বরাদ্দ স্বল্পতার কারণে ডাকবাংলোর সঠিক পরিচর্যা করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ।
জানা যায়, বৃটিশ শাসনামলে আনুমানিক ১ একর জায়গার উপর স্থাপিত হয় পাগলা বাজারের ঐতিহ্যবাহী এই ডাকবাংলো। ঐতিহ্যবাহী এই বাংলোটি অল্পক্ষণের জন্য হলেও তার বুক পেতে বরণ করে নিয়েছিল বরেণ্য রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিকসহ অসংখ্য গুণীজনকে। দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ, পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই ডাকবাংলোতে বিশ্রাম নিয়েছেন। করেছেন সভা-সমাবেশ।
এছাড়া বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, প্রয়াত বাউল সম্রাট শাহ্ আবদুল করিমসহ অনেক গুণী ব্যক্তিবর্গের বিশ্রামাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল এই ডাকবাংলো।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ইতিহাসের সাক্ষী পাগলা বাজার ডাকবাংলো প্রাঙ্গনের বিভিন্ন জায়গায় ময়লার স্তুপ। স্থানীয় যুবকদের উদ্যোগে বেডমিন্টন খেলার জন্য সামনের একপাশ পরিষ্কার করে পাকা করা হলেও এর পেছনের অংশের অবস্থা আরো ভয়াবহ। তৃণলতায় ছেয়ে গেছে ডাকবাংলোর পেছনের অংশ। এর ফাঁকে ফাঁকে পথচারীর মলমুত্র। এযেন অঘোষিত শৌচাগার। এছাড়া সন্ধ্যা হলেই বিদ্যুতের আলোয় পুরো বাজার আলোকিত হলেও অন্ধকারেই থেকে যায় পাগলা বাজার ডাকবাংলো। বিশালাকৃতির গাছে ঢাকা ডাকবাংলোতে তখন ভুতুড়ে অবস্থা বিরাজ করে।
ঐতিহাসিক এই স্থাপনার এমন বেহাল দশায় ক্ষোভ জানিয়েছেন স্থানীয়রা। স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটির রক্ষণাবেক্ষণে স্থানীয় প্রশাসন, সওজ এবং জনপ্রতিনিধিরা অনেকটা উদাসীন। নির্বাচন এলে প্রার্থীরা কতশত উন্নয়নের ইশতেহার ঘোষণা করেন। তবে কারো মুখে ডাকবাংলোর রক্ষণাবেক্ষণের কথা শুনা যায় না।
অনেকে ক্ষোভের সাথে সংশয় প্রকাশ করে বলেন, এখনই যদি ডাকবাংলো রক্ষণাবেক্ষণে কার্যকরী পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তবে সরকারী এই সম্পদ ভবিষ্যতে ভূমি খেকোদের পেটস্ত হতে পারে।
এব্যাপারে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আজাদ হোসেন বলেন, পাগলা বাজারের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটির সঠিক রক্ষনাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। সবার আগে যেটার প্রয়োজন তা হচ্ছে, চারপাশে নোংরা আবর্জনার স্তুপ পরিষ্কার করা। কেউ যেনো প্রস্রাব-পায়খানা না করে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এবং জন্য একটি টেকসই ফটক স্থাপন করা।
পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল আলম নিক্কু বলেন, পাগলা বাজার ডাক বাংলো একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এখানে অনেক বড় বড় জনসভা ও সমাবেশ হয়েছিল। আমি ইউপি চেয়ারম্যান থাকাকালীন এই স্থাপনাটি পরিত্যক্ত না হয় সেজন্য ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন কার্যক্রম এখানে স্থানান্তরিত করেছিলাম। বর্তমানে এর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এটি সংস্কার করে ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাটি সংরক্ষণের দাবি জানান তিনি।
সুনামগঞ্জ জেলা সড়ক ও জনপথের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল ইসলাম প্রামানিক বলেন, স্বল্প পরিমাণে আমাদেরকে মেরামতের বরাদ্দ দেয়া হয়। এই বরাদ্দ থেকে অন্যান্য উপজেলায় কাজ করি। তারপরও অর্থের স্বল্পতা দেখা দেয়। পাগলা বাজারের সরকারী ডাকবাংলো দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার করা হয়নি। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে বরাদ্দ পেলে ডাকবাংলোর সংস্কার ও সৌন্দর্য্য রক্ষায় কাজ করতে পারবো।
শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ফারুক আহমেদ বলেন, এই ডাকবাংলো একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। বৃটিশ আমল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে অনেক রথী-মহারথীরা এখানে এসেছেন। এর সৌন্দর্য রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরী। এই বিষয়ে আমরা বারবার সড়ক ও জনপথ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আশাকরি তাদের যথাযথ পদক্ষেপে এই সরকারী বাংলো আবারও প্রাণ ফিরে পাবে।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: জুনায়েদ চৌধুরী জীবন